কী বলব? ভূতের মুখে রাম নাম!
ভারত পাবজি–সহ ১১৮টি চিনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করায় চিনের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র হুয়া চেনিং টেনে এনেছেন রবীন্দ্রনাথকে। বলেছেন, ‘চিনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক জনপ্রিয়। আমরা তো রবীন্দ্রনাথকে কখনও চিনা সংস্কৃতির ওপর আঘাত বলে মনে করিনি!’
কী বলব? চিনা বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্রের ওই কথার পরিপ্রেক্ষিতে কীই–বা বলা যায়? প্রথমেই বলে রাখা ভালো, চিন খাতায়–কলমে কমিউনিস্ট দেশ হলেও সে দেশের সব মানুষই যে কমিউনিস্ট, তা কিন্তু নয়। তা–ই যদি হত, তা হলে ১৯৮৯ সালে তিয়েন আন মেন স্কোয়ারের ছাত্র বিক্ষোভে গুলি চালিয়ে চিন প্রশাসনকে কয়েক হাজার মানুষকে খুন করতে হত না। বলতে দ্বিধা নেই, গায়ের জোরে চিনে সাধারণ মানুষের কণ্ঠরোধ করে রেখেছে কমিউনিস্ট সরকার।
সেই গা–জোয়ারি মনোভাব এখন বেশি দেখাতে চাইছে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও। তবে এ ক্ষেত্রে সহজে সফল হওয়ার সম্ভাবনা যে তেমন একটা নেই, তা বুঝতে পেরেই নরমে–গরমে নানা পন্থা অবলম্বন করতে শুরু করেছে তারা। আর তাই নিজেদের স্বার্থেই টেনে এনেছে কবিগুরুকে।
কথা হল, হয়কে নয় করতে, আর নয়কে ছয় করতে জুড়ি নেই চিন নামে রাষ্ট্রটির। তারা মনে করে, তারা যে সব কথা বলবে, সব কথা সবাই বেদবাক্য বলে মেনে নেবে। যেমন মেনে নিতে বাধ্য করেছে নিজের দেশের প্রতিটি মানুষকে। যাঁরা মানতে পারেননি, তাঁদের জীবনে নামিয়ে দিয়েছে মৃত্যু গহন অন্ধকারের কড়াল ছায়া।
তাই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মিথ্যে কথা বলতেও তাদের কোনও দ্বিধা নেই। মনে রাখা দরকার, চিনে প্রথম যখন রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন, তাঁর বক্তৃতার সময় চিনা কমিউনিস্টরাই তীব্র বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন। ১৯২৩ সালে যখন রবীন্দ্রনাথের চিন সফরের কথা ঘোষণা করা হয়, তখন থেকে চিনা বুদ্ধিজীবীদের একটা বিশাল অংশ প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছিলেন।
মনে রাখতে হবে, কমিউনিস্ট পার্টি তখনও কিন্তু চিনের ক্ষমতা দখল করে নিতে পারেনি। ১৯৪৯ সালে চিনের ক্ষমতায় আসে কমিউনিস্ট পার্টি। কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতাসীন হওয়া পর যদি রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকতেন এবং তখন যদি তাঁর চিনে যাওয়ার কথা উঠত, তা হলে এ কথা নিশ্চিত ভাবেই বলে দেওয়া যায় বিশ্বকবিকে সেই অনুমতিই দিত না চিনের তথাকথিত কমিউনিস্ট সরকার।
১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথের চিন সফর নিয়ে সে দেশে যথেষ্ট বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। তখন যাঁরা রবীন্দ্রনাথকে বরণ করে নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অকমিউনিস্ট শিক্ষাবিদ ও কবি হু শি। তিনি কিন্তু রবীন্দ্র–বিরোধী কমিউনিস্ট বিক্ষোভ দেখে কবিকে নিরাশ হতে বারণ করেছিলেন। বরং জানিয়েছিলেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা তাঁদেরও আছে।
বলা বাহুল্য, ভুল ভেবেছিলেন হু শি। কারণ, তখন তিনি জানতেনও না যে, সেই কমিউনিস্টরাই একদিন ক্ষমতায় এসে চিন থেকে সমস্ত ধরনের বিরুদ্ধমতকে নৃশংস ভাবে অন্ধকূপে বন্দি করে দেবে। আর রবীন্দ্রনাথ কোনও দিন রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রচারক ছিলেন না। তাই তাঁর ভাবনা, তাঁর দর্শন–চিন্তায় তখন প্রভাবিত হয়েছিলেন চিনের তরুণ সমাজ।
যত দিন গিয়েছে, চিনের তরুণ সমাজের ওপর সেই প্রভাব ক্রমশ বেড়েই গিয়েছে। তাই তখন থেকে তাঁদের শান্তিনিকেতনে আসা শুরু হয়ে যায়। শুরু হয়ে যায় পড়াশুনো করাও। যেমন বহু–বহু বছর আগে সেই প্রাচীন কাল থেকেই চিনের তরুণরা নালন্দা–সহ ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেন পড়াশোনা করতে, তেমনই।
চিনের বিদেশ মন্ত্রকের রবীন্দ্র–আশ্রয় যে আজ বিশেষ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণটা আরও ভালো করে বাণিজ্য মন্ত্রকের মুখপাত্র গাও ফেংয়ের কথাতেই পরিষ্কার হয়ে যায়। তিনি বলেছেন, ‘ভারতের এই সিদ্ধান্তে বড় ক্ষতির মুখে পড়তে হবে চিনকে। এর ফলে চিনের লগ্নিকারীদের স্বার্থ লঙ্ঘিত হচ্ছে।’
সুতরাং, চিনের আপত্তির কারণটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। বাস্তবিকই তাই। তথ্য বলছে, গেমিং অ্যাপ পাবজি–র ডাউনলোডের দিক থেকে এক নম্বরে রয়েছে ভারত। প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি ভারতীয় এই অ্যাপ ডাউনলোড করেছেন। অর্থাৎ, সারা পৃথিবীর মোট ব্যবহারকারীর ২৪ শতাংশই ভারতীয়। তাই চিনের ক্রোধের কারণটা সহজেই অনুমেয়। এখনও পর্যন্ত ভারতে ২২৪টি চিনা অ্যাপ নিষিদ্ধ হয়েছে ভারতে।
আসলে, অপ্রিয় সত্য হল, চিন এবং ভারতের বাণিজ্য–দূরত্ব ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু, চিনের সঙ্গে ভারতের এই বাণিজ্য–দূরত্ব বৃদ্ধির কারণ তো শুধুই অর্থনৈতিক নয়! কারণটা লুকিয়ে রয়েছে দুই দেশের সম্পর্ক এবং চিনের মানসিকতার মধ্যে। গালোয়ান সঙ্ঘর্ষের পরে লাদাখ সীমান্তে আচমকাই হাজির হয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। যে সফর নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছিল চিন।
কিন্তু একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী, তাঁর দেশের কোথায় যাবেন, কোথায় যাবেন না, তা তাঁর ইচ্ছে বা অনিচ্ছের ওপর নির্ভর করে, অন্য দেশের ইচ্ছের ওপর নয়। বলা বাহুল্য, সেই সহজ সত্যটাও বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে দাম্ভিক বেজিং। তাই অরুণাচল প্রদেশেও ভারতের কোনও প্রধানমন্ত্রী গেলে অদ্ভুত কারণে তাদের নিশ্বাস–প্রশ্বাস ভারী হয়ে ওঠে।
যাই হোক, সেই সফরে গিয়ে নরেন্দ্র মোদি তাঁর স্বভাব–সিদ্ধ ভঙ্গিমায় সরাসরি কোনও দেশের নাম না করে কোনও কোনও দেশের ‘বিস্তারবাদের’ সমালোচনা করেছিলেন। —বিস্তারবাদ। মানে, সোজা কথায়, সাম্রাজ্যবাদ।
প্রধানমন্ত্রী মোদির সে কথারও সমালোচনা করেছিল চিন। বা তাদের সরকারের কণ্ঠস্বর ‘গ্লোবাল টাইমস’। ব্যাপারটা অনেকটা ‘ঠাকুর ঘরে কে? —আমি তো কলা খাইনি’র মতো আর কী!
কিন্তু, ভয়ঙ্কর সত্য হল, চিনের আচরণ সাম্রাজ্যবাদীদের মতো নয়, বরং তারা কমিউনিজমের খোলসে লুকিয়ে থাকা আস্ত একটি সাম্রাজ্যবাদী দেশই। এখন তো সেই হিসেবেই তারা (হয়তো অনিচ্ছা সত্ত্বেও) পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে ফেলেছে। কেন–না, এখন তাদের চরিত্র সকলের কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।
তা না হলে, তারা কেন তিব্বত দখল করে রেখেছে? ভারতের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, কেন হংকং নিয়ে তাদের এত ঝামেলা? কেন ফিলিপিনস, মায়ানমার, ভিয়েতনাম এবং তাইওয়ানের দিকেও তাদের দখল–দৃষ্টি বারবার আছড়ে পড়ছে? কেন মঙ্গোলিয়া নিয়ে তাদের এত মাথাব্যথা? এমনকী, রাশিয়ারও একটি অঞ্চল নিজেদের বলে দাবি করেছিল তারা। কিন্তু সেই অঞ্চল নিয়ে চিনের সঙ্গে যুদ্ধের কথা বেজিংকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে ক্ষুব্ধ রাশিয়া।
ফলে সাময়িক ভাবে চুপ করেছে তারা। তবে সেই চুপ কতদিনের জন্য, তা জানা নেই মস্কোরও। তাই তারা সেই অঞ্চলকে নিরাপদ রাখতে এখন সব রকম সতর্কতা অবলম্বন করেছে। আবার, চিনের সমস্যা রয়েছে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গেও। তার কারণও কিন্তু তাদের সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতাই।
একই সঙ্গে এ কথাও বলে দেওয়া যায়, কাঠমাণ্ডুর কমিউনিস্ট সরকার যদি এখনও সতর্ক না হয়, তা হলে আগামী কোনও দিন হয়তো সেই–সেই এবং সেই ‘ঐতিহাসিক’ কারণ দেখিয়ে গোটা নেপালটাকেই তাদের অংশ বলে দাবি করে বসবে চিন। সে দিন নেপাল কী করে আত্মরক্ষা করবে, তা ভাবতে গেলেও এখন মনের অভ্যন্তরেই ধাক্কা খেতে হয়।
ভারতে পাবজি নিষিদ্ধ করা নিয়ে চিনের প্রতিক্রিয়ার ভাষাটাও ভেবে দেখা দরকার। চিনের বাণিজ্য মন্ত্রকের মুখপাত্র সেই গাও ফেংই বলেছেন, ‘কোনও রকমের আলোচনা ছাড়াই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। এটি তাদের বড় ভুল। তারা যেন এই ভুল শুধরে নেয়।’
সমালোচনার ভাষাটা লক্ষণীয়। ভাবুন একবার! মানে, ভারত তাদের সঙ্গে বাণিজ্য করতে বাধ্য, ঘুরিয়ে এ কথাই বলতে চাইছে বেজিং। এটা তাদের স্পর্ধিত উক্তি কিনা, তা তাদের ভেবে দেখা উচিত। কারণ, প্রতিটি আঘাতের কিন্তু প্রত্যাঘাত থাকে। আর ভারত কিন্তু সেই ক্ষমতাটা রাখে।
না, এ কথা আমি বলছি না। এ কথা মনে করে জাপান। তারা বলেছে, ভারতের কী শক্তি আছে, তা কেউই জানে না। এমনকী, ভারতও নয়। চিন বেশি বাড়াবাড়ি করলে এবং ভারত যদি সত্যিই রণংদেহী মূর্তি ধারণ করে, তা হলে চিনকেই মুশকিলে পড়তে হবে।
অথচ, চিনের সন্দেহ, আমেরিকার পরামর্শেই নাকি ভারত এইসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এমন সন্দেহ, বলা বাহুল্য, অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরাও করবে কিনা, তাতেই বরং সন্দেহ আছে। তাই চিন ‘সুপরামর্শ’ দিয়েছে, আমেরিকার ছত্রচ্ছায়া থেকে যেন বেরিয়ে আসে ভারত।
এর আগেও আমেরিকার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা তারা মেনে নিতে পারেনি। তা নিয়ে তারা অনেকবারই ফোঁস করে উঠেছে। কিন্তু চিনের তথাকথিত কমিউনিস্ট নেতারা বুঝতে চান না, ভারত কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে, আর কার সঙ্গে করবে না, তা একান্তই ভারতের ব্যাপার। তা নিয়ে চিনের মাথাব্যথার কারণ থাকতে পারে না।
তা হলে তো চিনের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির চেষ্টাকে আমল দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ বা শ্রীলঙ্কার ওপরও ভারত চাপ তৈরি করতে পারত। কখনও তো করেনি। বরং ঐতিহাসিক এবং ভৌগোলিক দিক থেকেই চিনের তুলনায় বাংলাদেশ বা শ্রীলঙ্কার কাছে ভারতই কাছের বন্ধু। এটা সেই দেশগুলিও ভালো করেই জানে। তাই তারা চিনের বন্ধুত্ব গ্রহণ করলেও ভারতকে ছেড়ে চলে যায়নি।
আর চিনের বন্ধুত্ব যে কী বিষম ব্যাপার, তা ক্ষমতালোভী ইমরান খান বা কে পি শর্মা অলি বুঝতে না চাইলেও পাকিস্তান এবং নেপালের রাজনৈতিক, শিক্ষা এবং সংস্কৃতি মহল থেকে শুরু করে জনসাধারণও ধীরে ধীরে টের পেতে শুরু করেছে এখন।
চিন সম্ভবত নিজেদের সর্বশক্তিমান ভাবতে চাইছে। সত্যি কথা বলতে কী, এমন ভাবনাচিন্তা তাদেরই বিপদ ডেকে আনতে পারে। ইতিহাস অন্তত সেই শিক্ষাই দেয়। কথা হল, চিন সেই ইতিহাসকে স্বীকার করে না।
তবু চিনকে অশিক্ষিত বলতে চাই না। উচিতও নয়। প্রমাণ অবশ্যই তাদের সংস্কৃতি।
বরং বলা যায়, ক্ষমতা দম্ভে তাদের স্পর্ধা কুশিক্ষিত মনোভাবেরই পরিচয় দিচ্ছে।
লেখক:উপমন্যু রায়,কলকাতা।